এক
রাতের খাবারটা মাত্রই খাওয়া শেষ করেছে দিয়া। মাটির ঘরের সামনের জায়গাটুকুতে এখন পানি দিয়ে এঁটো বাসনগুলো ধুয়ে রাখছে। রাত খুব বেশি হয়নি, কিন্তু এটুকুতেই গ্রামাঞ্চলে অন্ধকার নেমে এসেছে। দুটো প্লেট ইতোমধ্যেই ধোয়া হয়ে গেছে। তিন নম্বর প্লেটটার কোণায় তিন আঙুল ঘষে লেগে থাকা ভাত ওঠাতে ওঠাতে শুনতে পেল মায়ের চিৎকার, ‘কিরে দিয়া? হল?’
প্রায় হয়েই এসেছে। দিয়াও তাই পাল্টা জবাব দিয়ে জানান দিল, প্রায় হয়ে এসেছে তাঁর। শেষবারের মত তিনটে প্লেটে পানি ঢেলে উঠে গিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল সে। দরজাটা লাগিয়ে দিল খট করে। রাত-বিরেতে তাঁর ভয় হয় বড্ড। এমনিতে দিনকাল ভাল না, কাছেই প্রাইমারি স্কুলটাতে পাকিস্তানীরা নাকি ক্যাম্প করেছে। সারাক্ষণ ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়। এর মধ্যে কখন যে কি হয়ে যায় কেউ বলতে পারেনা। দরজাটা ভিতর থেকে ভাল করে লাগিয়ে দেয় সে।
বাবা,মা আর সে- মাত্র তিনজনেরই সংসার তাঁদের। দারিদ্র্যের কারণে এই কুঁড়েঘরটাই তাঁদের একমাত্র সম্বল। আগে দিয়ার বাবা গ্রামে অন্যের জমিতে টুকটাক কাজ করত, এখন ওদিক দিয়েও অবস্থা বেশ শোচনীয়। দেশে পাকিস্তানী উৎপাত বাড়লেও প্রথম দিকে তাঁদের গ্রামটা ঠিকই ছিল। রেডিওতে মাঝে মাঝে দুয়েকটা খবর পেত। কিন্তু আজকে মাস দুই হল তাঁদের গ্রামেও বুট পরা পাকিস্তানীদের দেখা যাচ্ছে। গ্রামের রকিবকে পাকিস্তানীদের সাথে চলতে দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় মসজিদের ইমাম সেলিম তো আজকাল স্কুলঘর থেকে নড়েই না।
মাটিতে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ল দিয়া। ঘরে কোন খাট নেই। এভাবেই প্রতি রাতে ঘুমাতে হয় তাঁদের। দিয়ার বাবা হোসেন মিয়া অবশ্য একটা চৌকি কিনবেন বলে ভেবেছিলেন, কিন্তু সেসব এখন আর হয়ে উঠছে না। তিনবেলা খাবারই এখন জোটানো পিঠের ওপর চেপে বসেছে, চৌকি কেনার চিন্তা এখন সে হিসেবে বিলাসিতা মাত্র।
হ্যারিকেনের নব ঘুরিয়ে আলো নিভিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল দিয়া আর তাঁর পরিবার!
দুই
দিয়ারা যেখানে ঘুমাচ্ছে, সেখান থেকে পায়ে হাঁটা পথে মিনিট পাঁচেক গেলেই স্কুলঘর। আগে জায়গাটা দিনের বেলায় মুখরিত হয়ে উঠত ছেলেমেয়েদের কোলাহলে। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। মুক্তির আশায় চাতক পাখির মত চেয়ে থাকা জনগণ মৌলিক চাহিদার কথা ভুলে যায়, দিয়াদেরও হয়েছে তাই। ওরা ভুলে গেছে স্কুলের কথা, শিক্ষার কথা। আলোর মুক্তির চেয়ে এখন সবচাইতে জরুরী শোষণের মুক্তি। সেসবের জন্যে স্কুলঘরটা এখন সাক্ষাৎ যমদূতের কেল্লার মত।
হঠৎ সেই যমদূতের কেল্লার সামনে এসে থামল সবুজ রঙের একটি জিপ। এমনিতে জিপ যা আসার দিনের বেলাতেই আসে। আজকে হঠাৎ ঢাকা থেকে জরুরী খবর নিয়ে এসেছে কেউ।
জিপের দরজা খুলে মাটিতে পা রাখতে দেখা গেল একজোড়া বুটকে। বুট পরিহিতার গায়ে পাকিস্তানী মিলিটারির পোশাক। তবে ব্যাজ দেখে উচ্চ র্যাংকধারী কেউ বলে মনে হচ্ছে । হাতে করে একটা কাগজ নিয়ে এসেছে সে। বেশ অহমিকার সাথে গাড়ির দরজা বন্ধ করে স্কুলঘরের দিকে এগিয়ে গেল এইমাত্র জিপ থেকে নামা সেই মিলিটারী।
স্কুলঘরের সামনে পাহারাতে দেখা গেল দুই সৈনিককে। ওদের প্রায় ঝিমুনী চলে এসেছিল। গাড়ির শব্দে তড়াক করে উঠে বসেছে। এমনিতে খুব বেশি হিসেবি থাকার প্রয়োজন মনে করে না ওরা। কেউ কিছু উল্টোপাল্টা করলেই রাইফেলের একটি গুলি বরাদ্দ করাই আছে।
পাকিস্তানী মিলিটারির পোশাক পরা কাউকে এগিয়ে আসতে দেখে হাত উঠিয়ে সালাম ঠুকলো ওরা। ওদের মধ্যে একজন তাকে নিয়ে গেল ভেতরে। ভেতরে আরো বড় একজন মিলিটারী অফিসার আছে। মসজিদের ইমাম সেলিমও আছে। কিছু একটা হয়তো ঘটবে আঁচ করতে পারছে ওরা দুইজন। আদার ব্যাপারীর জাহাজের খোঁজ নিয়ে কাজ নেই, ওরাও তাই সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। নতুন আসা মিলিটারীর লোকটাকে ঘরের ভেতর পৌছে দিয়ে আবার নিজের জায়গায় এসে দাঁড়াল পাকিস্তানী সৈনিক।
রাতটাকে বড্ড বেশি অন্ধকার লাগছে!
তিন
পেটের সমস্যাটা বড্ড বেশি শিমুলের। রাত বিরাতে উঠে তাই শৌচাগারে যেতে হয় তাকে। আজকেও বেশ আয়েশ করেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। কিন্তু হঠাৎ করেই পেটের ভেতর মেঘ ডেকে উঠল। অগত্যা উঠে গিয়ে এখন শৌচাগারে যেতে হচ্ছে তাকে।
শিমুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঢাকায় গন্ডগোলের সুবাদে ওর বাবা ওকে ধরে এনেছে গ্রামে। তবে শিমুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দিন দুয়েক পর বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আবার ঢাকাতে ফিরে যাবে ও। দেশের বিপদের মুহূর্তে এভাবে হাত গুটিয়ে গ্রামে বসে থাকার মানে হয়না। এছাড়া তাঁর বাবা হয়তো গ্রামটাকে নিরাপদ ভাবছেন, কিন্তু সেটাই বা কতদিন থাকবে কে জানে। শিমুলকে ঢাকা ফিরে যেতেই হবে।
শৌচাগারের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল শিমুল। আজ রাতে অন্তত একটা ভাল ঘুম হবে তাঁর। দ্রুতই ডাক্তার দেখাতে হবে, ভাবছে সে। গাঢ় অন্ধকারের মাঝে মাঝখানেরর উঠোনটা পেরিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে জিপের আওয়াজে থমকে দাঁড়াল ও। তাঁদের বাড়ির সামনেই খোলা মাঠ, মাঠটা পেরিয়েই স্কুলঘর। শিমুল দেখতে পাচ্ছে, সেই স্কুলঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সবুজ রঙের জিপ। এই জিপ শিমুলের চেনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই জিপ বহুবার দেখেছে সে। মুহুর্তেই তাঁর শরীর বেয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল, জিপের শব্দ যমের শঙ্খের চাইতে কম কিছু লাগেনি তাঁর কাছে!
কিছুক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হয়ে ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল সে। তাঁর মন বলছে, এ গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে তাকে, সম্ভব হলে তাঁর স্ত্রী বিয়োগে শোকাহত বাবাকে নিয়েই!
চার
নতুন আসা পাকিস্তানী মিলিটারীটা স্কুলঘরের ভেতরে ঢুকে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। সবকিছু বেশ ঠিকঠাকই চলছে, আন্দাজ করল সে। সামনে একটা টেবিলের ওপাশে মোটা গোঁফের জাদরেল চেহারার একজন অফিসার বসে আছে। নতুন আগন্তুককে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে সালাম জানাল সে। মাথা নাড়িয়ে অভিবাদন গ্রহণ করে হাতে রাখা কাগজটা বাড়িয়ে দিল সে টেবিলের ওপাশে থাকা জাঁদরেল চেহারার অফিসারের দিকে, হাত বাড়িয়ে সেটা নিল সে।
চিঠিটা খানিক্ষণ পড়ে নিয়ে মুখ তুলল জাঁদরেল চেহারার সেই অফিসার, ‘ইতনি জালদি মে?’
এতক্ষণে মুখ খুলল আগন্তুক, ‘রাও ফরমান সাব নে বোলা থা, জালদি সাব সাফ কারনা হে। ইয়ে মাটি চাহিয়ে উসকো, জিন্দা মারদ বিনা!’
মুখে কুটিল হাসি ফুটে উঠল জাঁদরেল চেহারার সেই অফিসারের। এসবের জন্যেই তো সিন্ধু ছেড়ে পদ্মার দেশে এসেছে সে!
পাঁচ
দিয়া আর শিমুলদের বাড়িটা একেবারে পাশাপাশি। খুব ভোরে উঠে ঘরের দরজা খুলে দিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াতেই সামনের রাস্তায় দেখা গেল শিমুলকে। দেখেই ডাক দিল দিয়া, ‘ও শিমুল ভাই, কবে আইলা?’
দিয়ার ডাক শুনে থেমে দাঁড়িয়ে পড়ল শিমুল, পরশু এসেছে সে এই গ্রামে। এসে প্রথমদিন ঘরেই ছিল । আজ গেছিল বাজারের দিকে বাবার জন্যে সুপারি কিনতে। দিয়ার ডাক শুনে বাঁয়ে ঘুরে এগিয়ে এল দিয়াদের উঠোনে।
‘পরশু আইছি, কিরম আছিস?’
‘আমগো আর থাকা, আছি কোনরকমে টিইক্যা’
শিমুলকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। দিয়াদের দারিদ্র্যের গল্প শোনার জন্যে তাকে খুব বেশি মনোযোগী মনে হল না। সে দিয়ার উত্তরে ‘হুম’ বলে ছোটখাট একটা জবাব দিল মাত্র। কালকের জিপটা ভীষণ চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তাকে। সে বাড়ি ফেরার জন্যে উদ্যত হল। যাবার সময় শুধু সাবধানে থাকতে বলে গেল দিয়াকে।
কিন্তু শিমুল ভাই কেন সাবধানে থাকতে বলে গেলেন বুঝতে পারল না দিয়া!
ছয়
রকিব আর সেলিমকে বেশ ব্যাস্ত দেখাচ্ছে। হঠাৎ করেই লোক পাঠিয়ে তাঁদের দুইজনকে স্কুলে ডেকে এনেছেন স্কুলে থাকা পাকিস্তানী মিলিটারির অফিসার। সেখান থেকে এরা চলে গেছে গ্রামের বাজার এলাকাটায়। এখানে পাকিস্তানী একটা জিপ আসার কথা। জিপের ড্রাইভার গ্রামটা ভাল করে চেনেনা। রকিব আর সেলিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ড্রাইভার বাজার অব্দি পৌছলে পথ দেখিয়ে স্কুলঘর অব্দি নিয়ে আসার। এখন বড় রাস্তার পাশে বাজারটায় চায়ের দোকানে দুইজন তাই অপেক্ষা করছে জিপটার।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে রকিবকে জিজ্ঞেস করল সেলিম, ‘কী ব্যাপার কও দেখি মিয়া? এরম তোড়জোড় তো সার গো আগে দেহিনাই’
‘তা আমি কিরাম করে জানব? বললো তো জিপ নিয়ে যাওয়ার পর বলবেনে’
‘ও’ বলে আবারও চায়ে চুমুক দিল সেলিম। ঘটনার আদ্যপান্ত ধরতে পারছেনা সে। তবে তা নিয়ে খুব বেশি মাথাও ঘামাচ্ছে না। তার চিন্তা টাকাপয়সা আর মেয়ে নিয়ে । সেটা পাওয়ার আশ্বাসেই সে পাকিস্তানী মিলিটারির হয়ে কাজ করছে। স্কুলঘরে থাকা পাকিস্তানী মিলিটারির অফিসার তাকে কথা দিয়েছে সেটা যথাসময়েই পেয়ে যাবে সেলিম। সেলিম সেই কথা বিশ্বাস করে নিয়েছে।
হঠাৎ জিপের শব্দে সেলিমের ভাবনাতে ছেদ পড়ল। স্কুলঘর থেকে তাদের বলা হয়েছিল, ঢাকা থেকে জিপ আসবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যেটা এসেছে সেটা কোন জিপ নয়। বড়সড় একটা মিলিটারী ট্রাক এসে থেমেছে বাজারের মাঝে। ট্রাকের পিছে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না। ট্রাকটির ড্রাইভার নেমে এসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ঢাকা থেকে তাকে বলা হয়েছে, বাজারে তাকে দেখা মাত্র দুইজন এগিয়ে আসবে। এখনও সেই দুইজনের দেখা মিলছে না।
মিলিটারী ট্রাকটা দেখে এগিয়ে গেল সেলিম আর রফিক। এখন ওটাতে চড়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে স্কুলঘরে!
সাত
ঘরের সামনে বড় উঠোনটা ঝাড়ু দিচ্ছিল দিয়া। শিমুল ভাইয়ের সাবধানবাণী তখনও মাথা থেকে সরাতে পারেনি। তবে কিছুই যে আঁচ করতে পারেনি এমন নয়। এমনিতে যেদিন থেকে পাকিস্তানীরা স্কুলঘরটাতে এসে আস্তানা গেড়েছে, সেদিন থেকেই ভয় জেঁকে বসেছে ওদের মনে। পাকিস্তানী মিলিটারী দেখলেই ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে ওদের। দিয়ার বাবা ওকে এখন আর উঠোনটা পেরোতে মানা করে দিয়েছেন। কদিন আগে পাশের গ্রামের রিমাকে ধরে এনে ওরা…
পাকিস্তানী মিলিটারীর ট্রাকের শব্দে চমকে সম্বিৎ ফিরে পেল দিয়া। উঠোনের সামনেই রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে সোজা যাওয়া যায় স্কুলঘরে। এখন সেই রাস্তা দিয়ে স্কুলঘরের দিকেই যাচ্ছে একটি মিলিটারী ট্রাক। পিছনে কিছু একটা আছে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু কি আছে বোঝার কোন উপায় নেই। ড্রাইভিং সিটে রকিব আর সেলিমকে দেখা যাচ্ছে।
দিয়া জানে না কেন, পাকিস্তানী মিলিটারীর ট্রাকটা দেখা মাত্রই ওর বুকটা ছ্যাৎ করে কেঁপে উঠল। ও স্পষ্ট দেখতে পেল, ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা মিলিটারীর পোশাক পরিহিত ড্রাইভার ওর দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়েছে। আর একজন মেয়ে হিসেবে এই চোখের ভাষা ও বোঝে। দিয়া ছুটে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিল।
দিয়া জানেনা, ততক্ষণে মিলিটারীর ড্রাইভারের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠেছে। ফিসফিস করে সে বলছে, ‘আগলি রাত মে দেখ লেঙ্গে…’
আট
স্কুলে থাকা মিলিটারীর বড় অফিসারের সামনে বসে আছে রকিব আর সেলিম। ট্রাকটা স্কুলের মাঠের এক কোণায় রাখা হয়েছে। এরপরই সেলিম আর রকিবকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ঠিক কি করতে হবে। সবটা শুনে সেলিমের মুখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠছে। রকিবের প্রথম দিকে একটু ভয়ার্ত লাগলেও পাকিস্তানী মিলিটারীর বড় অফিসারের কথাতে সেও এখন উদগ্রীব হয়ে আছে। একটু সামনে ঝুঁকে সে জিজ্ঞেস করল,
‘কিস রাত?’
‘কাল’ বাতাসে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল মিলিটারির অফিসার। সেলিম আর রকিব একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিল একবার।
নয়
পঁচিশে মার্চ, ১৯৭১। রাতের খাবার সেরে দিয়া উঠোনে বসে বাসন ধুয়ে নিচ্ছিল। আজকের রাতে আগের দিনের মত অতটা অন্ধকার নেই। বরং একটু আলোই দেখা যাচ্ছে, খুব সম্ভবত জ্যোৎস্নার কল্যাণে। বাসন ধুতে ধুতে একেকবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল দিয়ার। ও বুঝতে পারছিল না ঠিক কীসের ভয়ে ওর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
শেষ প্লেটটা ধুয়ে উঠতে যাবে, এই সময় হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে শিমুলের চিৎকার শোনা গেল। হঠাৎ বার দুয়েক রাইফেলের গর্জনও শোনা গেল মনে হল। এক ছুটে ঘরের ভেতরে চলে এল দিয়া। মেঝের ওপর পাতা পাটিতে শুয়ে ততক্ষণে থমথমে মুখে বসে আছে দিয়ার বাবা আর মা।
একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওরা। যা বোঝার বুঝে ফেলেছে। অনাগত বিপদ সম্বন্ধে আঁচ করে ফেলেছে। এ রাত…… কালরাত!
দশ
তিনজন মিলিটারী সৈনিককে জ্যোৎস্নার আলোতে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে রকিব। সৈনিকদের একজন রকিবকে জিজ্ঞেস করেছে ‘লাড়কি’ কোথায় মিলবে। ভাল মেয়ে দেখাতে পারলে রকিবকে ‘ইনাম’ দেবে বলেছে ওরা। রকিব তাই সৈনিকদের দিয়ার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
রাস্তাটা পেরিয়ে উঠোনে ঢুকল চার জনের দলটা। তিনজনের কাছেই বন্দুক আর রাইফেল আছে। পাকিস্তান থেকে ওদের ওপর আদেশ দেওয়া হয়েছে, আজ রাতের মধ্যে এই গ্রামটা লন্ডভন্ড করে দেওয়ার। আজ রাতে ওরা এ গ্রামে যা চায় তাই করতে পারে। ওদের ওপর কোন বিধিনিষেধ নেই। কারো পরোয়া করতে হবেনা আজকে। সৈনিকেরা তাই এক এক করে খুনে উল্লাসে মেতে উঠছে।
রকিব ওদের বলল, এই সেই বাড়িটা। সৈনিকেরা বাংলা বোঝেনা ।তবে রকিবের আঙুলের ইশারাতে বাড়িটা ঠিকই দেখে নিতে পারল। হাতে রাইফেল নিয়ে ওদের একজন এগিয়ে যাচ্ছে বাড়িটার দিকে। আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ির সামনের উঁচু অংশটায় উঠে গেল ও। ভেতর থেকে আলো দেখা যাচ্ছে দরজার ফাঁক গলে। দরজায় এক লাথি দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল সৈনিকটা।
ভেতরে কেউ নেই!
এগারো
পাকিস্তানী রাইফেলের গর্জন শোনার পর দিয়া ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই ওরা সপরিবারে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। পাশেই স্কুলঘর, এখন ঐ কুঁড়েতে থাকার অর্থ নিশ্চিত বিপদকে আলিঙ্গন করা। দিয়ার মায়ের হাতে শুধুমাত্র একটা পুটুলি। ওটাতে কিছু চিড়া নেওয়া আছে। দিয়ারা জানেনা এখন কোথায় যাবে। ঘর থেকে বেরিয়ে ওরা রাস্তা ধরেনি, তাতে যে কারো চোখে পড়ে যাবার ভয় আছে। বাড়ির পেছন দিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছে ওরা। তবে কিছুদূর এগোবার পর চার/পাঁচজন মানুষের গলা শুনতে পেয়েছে দিয়া। ভয়ে আত্মা খাঁচাছাড়া হবার যোগাড় তখন ওর।
দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা তিনজন। শিমুলদের বাড়িটা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডানদিকের আকাশ ধোঁয়াতেই ধূসর হয়ে গেছে। শিমুল ভাইয়ের জন্যে আচমকা মন খারাপ হয়ে গেল দিয়ার। শিমুল ভাই-ই ওকে বলেছিল সাবধানে থাকতে । আর সেই শিমুল ভাই-ই কিনা সাবধানে থাকতে পারল না।
কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল দিয়া আর ওর বাবা-মা। সামনে কারো পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে!
বারো
পাকিস্তানী মিলিটারির আক্রোশ থেকে বাবাকে বাঁচাতে পারেনি শিমুল। পরপর দুটো গুলি করে ওদের বাসাটা জ্বালিয়ে চলে গেছে মিলিটারিরা। একটা গুলিতে ওর বাবা মারা গেলেও, শিমুল জখম হয়েও বেঁচে আছে। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গলটায় আশ্রয় নিয়েছে ও এখন। হাঁটার আর শক্তি নেই। তবুও অল্প অল্প হেঁটে যাচ্ছে ও। এই রাতে এক জায়গায় স্থির থাকা মানে, স্বয়ং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে পড়ল শিমুল। সামনে কেউ আসছে মনে হচ্ছে। চট করে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ও। সামনের পায়ের আওয়াজটাও হঠাৎ করে থেমে গেছে। ওকে কি দেখে ফেলেছে?
আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। গাছের নিচেই শুয়ে পড়ল শিমুল। জীবনীশক্তির শতভাগ নিংড়ে দিয়েও চোখ মেলে রাখতে পারছে না। ও কী মারা যাচ্ছে? হঠাৎ দূরে কোথা থেকে যেন একটা মেয়েলি কন্ঠ শুনতে পেল ও। কন্ঠটা পরিচিত ঠেকল শিমুলের কাছে। এসব কী ওর কল্পনা?
তেরো
নাহ, সামনে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। আবার চলতে শুরু করবে, আচমকা কোথা থেকে দিয়াদের পেছনে এসে হাজির হয়েছে পাকিস্তানী মিলিটারিরা। তিনজনের একটা দল, সামনে রকিবকে দেখা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, রকিবই ওদের পথ দেখিয়ে বাড়ির পেছনে নিয়ে এসেছে। দিয়ার শরীর বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। পাকিস্তানী মিলিটারি তিনজনকে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত লাগছে। ওদের দিকে বন্দুক তাক করে রেখেছে।
জঙ্গলের জোনাকির শব্দ ছাপিয়ে বুলেটের পরপর দুটি শব্দ শোনা গেল আচমকা। কেঁপে উঠে দিয়া দেখল, ওর একটু আগের জীবিত বাবা-মা এখন দুটি লাশ মাত্র। রকিব এসে ওর হাত চেপে ধরল হঠাৎ। টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে মিলিটারিদের কাছে। মিলিটারিদের চোখে ক্রুরতা ফুটে উঠছে।
দিয়াকে এখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্কুলঘরে………।